হাজার হাজার বছর আগে ছোট্ট একটি শিশু এক খাঁড়ি (Creek) থেকে অবাক করা এক চকচকে পাথর খুঁজে পায়। সুন্দর সেই পাথরটি সবার নজর কাড়ে। এবং এভাবেই প্রথমবারের মতো মানবজাতি স্বর্ণের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে।
স্বর্ণ ভাল লাগেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে নারীদের কাছে তো এর আকর্ষণ একেবারেই অন্যরকম। চকচকে, হলুদ বর্ণ এবং প্রাকৃতিক চেহারায় স্বর্ণ যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তখন তা সারা বিশ্বজুড়ে জলপ্রবাহে পাওয়া যেত। সন্দেহ নেই, মানবজাতির কাছে এটাই ছিল তখন প্রথম ধাতু।
দিনে দিনে স্বর্ণ প্রত্যেক মানব সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে ওঠে। এর উজ্জ্বলতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চমৎকার নমনীয়তা এবং রঙ-জ্বলা প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে স্বর্ণ দিয়ে নানা রকম জিনিস বানানোর কাজ খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠতে থাকে।
মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণের প্রথম ব্যবহার ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালের কাছাকাছি সময় যখন লিডিয়ান বণিকরা প্রথম মুদ্রা তৈরি করে। এগুলো শুধুই স্ট্যাম্প করা ছিল যার ৬৩% স্বর্ণ এবং ২৭% রুপার মিশ্রণ। একে বলা হতো ‘ইলেকট্রাম’। কোনো সন্দেহ ছাড়াই এই মানসম্মত ইউনিট লিডিয়ান ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছিল, কারণ লিডিয়ার শেষ রাজা, মার্মনাদায়ির ক্রোয়েসাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০-৫৪৬) সময় স্বর্ণের বিশাল ভাণ্ডার সংগ্রহ করেছিল লিডিয়া। আজও আমরা অতি-ধনী ব্যক্তিদের ‘ক্রোয়েসাসের মতো ধনী‘ হিসেবে আখ্যা দিই।
প্রাচীন গ্রিকবাসী স্বর্ণের বাস্তব ব্যবহার জানতো অনেক বেশি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রিকরা জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে শুরু করে এশিয়ার পূর্বাঞ্চল, এশিয়া মাইনর এবং মিশর পর্যন্ত স্বর্ণ উত্তোলন করেছিল। এসব খনির কিছু কিছু ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আবার কিছু ছিল বেসরকারি খাতের তবে বেসরকারি খাত থেকে রাষ্ট্রকে কর দিতে হতো। সিথিয়ান বা সাইবেরিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী যাযাবর ও সুমেরীয়রাও সব অঞ্চলের স্বর্ণখনিতে কাজ করেছে। গ্রিকদের স্বর্ণমুদ্রা ও সাইবেরীয়দের সোনার গহনার নির্মাণশৈলী এখনো তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়।
এরপর রোমান সাম্রাজ্যও স্বর্ণের খোঁজ করেছে। রোমানদের সাম্রাজ্যজুড়েই স্বর্ণখনি ছিল। তারা বিজ্ঞান ও স্বর্ণখনির কাজকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে। হাইড্রোলিকভাবে তারা স্বর্ণখনিতে পানির প্রবাহ নিয়েছে এবং তারাই স্লুইস তৈরি করেছে; তারাই সর্বপ্রথম লম্বা কুঠার তৈরি করেছে। রোমানরা মাটির নিচ থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করেছে এবং পানির চাকা (water-wheels) চালু করেছে। তারাই পাথর থেকে স্বর্ণকে আলাদা করার ব্যবস্থা করেছিল। স্বর্ণক্ষেত্রে রোমানদের অবদান অনেক বেশি।
কোনো সন্দেহ নেই, স্বর্ণ, রুপা কিংবা অন্য ধাতুর মুদ্রা স্ট্যান্ডার্ড ওজন ও সুন্দর মুদ্রার ধারণা বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান ও সমৃদ্ধিকে সম্ভব করতে পেরেছে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগে স্বর্ণ এবং রুপা উভয়ই ব্যবহৃত হতো ভারতে মসলা বেচাকেনার জন্য এবং চীনে সিল্কের জন্য। রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের চূড়ান্ত মুহূর্তে (৯৮-১৬০ খ্রিস্টাব্দে), রোমানদের স্বর্ণ ও রুপার মুদ্রা ব্রিটেন থেকে উত্তর আফ্রিকা ও মিশরকে শাসন করেছে।
পৃথিবী কেন স্বর্ণের মুদ্রা থেকে সরে গেল?
এটা ছিল মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং গ্রেশামের সূত্রের মধ্যকার একটি সমন্বয়। পুরনো দিনে যখন স্বর্ণ দিয়ে মুদ্রা তৈরি হতো তখন মুদ্রার কিছু অংশ ভেঙে সেগুলোকে গলিয়ে স্বর্ণের পাতে রূপান্তরিত করে বিক্রি করা হতো। যেহেতু অবমূল্যায়িত মুদ্রাগুলোর আর্থিক মূল্য ছিল বেশি সে কারণে যেসব মানুষ মুদ্রা থেকে সামান্য স্বর্ণ ভেঙে নিত তারা তা বিক্রি করে লাভবান হতো। এই প্রবণতা তখনই বেশি হলো যখন স্বর্ণ বা রুপার মতো মূল্যবান ধাতুর দাম বাড়লো।
মুদ্রার যে ‘ফেইস ভ্যালু’ ছিল তার চেয়ে মুদ্রায় ব্যবহৃত মূল্যবান ধাতুর দাম বেড়ে যাওয়ার ফলেও মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়। মূল্যবান ধাতুর বাজারমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে মুদ্রার স্বাভাবিক দাম ফেইস ভ্যালুর চেয়ে বেড়ে গেল।
এর ফলে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে মুদ্রাকে সোনা বা রুপার খণ্ড বা বার হিসেবে ব্যবহার করেও লাভ করা যাচ্ছিল। এটা অর্থ বিনিময়কারী এবং যেসব লোক অবৈধভাবে মূল্যবান ধাতু গলিয়ে বা ভেঙে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতো তাদের জন্য সুবিধা বয়ে আনল। মুদ্রাকে গলানো হতো এবং সেগুলো পাচার করা হতো।
অবমূল্যায়নের অর্থ হলো মূল্যবান ধাতুর সঙ্গে (সাধারণত স্বর্ণ বা রূপা) সাধারণ অএকটি ধাতু বেশি পরিমাণে মেশানো যা মুদ্রার মূল্য ঠিক রাখে এবং মুদ্রার ফেইস ভ্যালুও সংরক্ষণ করে। বেশি মুদ্রা বানানো এবং বেশি অর্থ তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকে মুদ্রার এই অবমূল্যায়ন ঘটানো হলো। কিন্তু এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিল এবং পুরনো যে মুদ্রায় মূল্যাবান ধাতু ব্যবহার করা হতো লোকজন তা জমা করতে থাকলো।
১৫২৬ সালে টিউডরের সময় কার্ডিনাল ওলসির মাধ্যমে প্রথম মুদ্রার অবমূল্যায়নের জন্য বড় ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। অষ্টম হেনরির শাসনমালের শেষ বছরগুলোতে বার বার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয় এবং ৬ষ্ঠ এডওয়ার্ডের সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল।
স্কটল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে ১৫৫১ সালে মুদ্রার মূল্যমান কমে গেল ব্যাপকভাবে। অষ্টম হেনরির শাসনমালে মুদ্রার যে অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছিল তার মান এখন চার ভাগের এক ভাগ থেকে ছয় ভাগের এক ভাগে চলে এলো। এর পরিণতিতে মুদ্রার ওপর রুপার প্রলেপ এত পাতলা হয়ে গেল যে, নিচের তামা দেখা যেতে লাগলো। এটা ঘটলো বিশেষ করে মুদ্রার ওপর থাকা অষ্টম হেনরির ছবির নাকের ওপর। ফলে লোকজন অষ্টম হেনরির ডাক নাম দিল “ওল্ড কপার নোজ”।
গ্রেশামের সূত্র
গ্রেশামের সূত্র অনুযায়ী, অর্থনীতে বলা হয়, “খারাপ মুদ্রা বাজার থেকে ভালো মুদ্রাকে বিতাড়িত করে।” ঠিক একইভাবে যদি মুদ্রায় বিভিন্ন মূল্যের ধাতু ব্যবহার করা হয় আর যদি কেনাকাটার ক্ষেত্রে একই মূল্যমান থাকে তাহলে বেশি দামী ধাতুর মুদ্রাটি ধীরে ধীরে বাজার থেকে উধাও হয়ে যাবে। লোকজন এ মুদ্রাটিকে হয় জমা করা শুরু করবে, না হয় বাইরে পাচার করবে।
রানী প্রথম এলিজাবেথের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা স্যার থমাস গ্রেশাম সর্বপ্রথম এ সূত্রের কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়। তবে ১৫৫৮ সালে দেয়া এ ব্যাখ্যাকে অর্থনীতিবিদ Henry Dunning Macleod, ১৮৬০ সালে স্যার থমাস গ্রেশামের সূত্র বলে আখ্যায়িত করেন।স্যার থমাস গ্রেশাম ছিলেন ১৫১৯ থেকে ১৫৭৯ সাল পর্য়ন্ত টিউডর রাজবংশের শাসনামলে একজন ধনীক ব্যক্তি ছিলেন। তবে এর পূর্বেও আরো অনেকে এই ধারণার অবতারণা করেছিলেন। সর্বপ্রথম এই বিষয়টি উল্লেখ করেন নিকোলাস কোপার্নিকাস। এজন্য এই সূত্র কোথাও কোথাও কোপার্নিকাস ল’ নামেও পরিচিত।
গ্রেশামের সূত্র অনুযায়ী “খারাপ মুদ্রা বাজার থেকে ভালো মুদ্রাকে বিতাড়িত করে।” মুদ্রার মূল্যমানের ক্ষেত্রে গ্রেশামের সূত্র বলছে যে, যদি নতুন মুদ্রা (খারাপ মুদ্রা) একই মূল্যমান নিয়ে বাজারে আসে কিন্তু পুরনো মুদ্রার (ভালো মুদ্রা) ফেইস ভ্যালু বেশি থাকে এবং তাতে বেশি মূল্যবান ধাতু থাকে তাহলে নতুন মুদ্রা বাজারে চালু থাকবে এবং পুরনো মুদ্রা বাজার থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
সর্বপ্রথম মুদ্রা (Coin) স্বর্ণ, রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং এগুলোর যার যার মূল্য অনুযায়ী মান নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দামি ধাতু দিয়ে মুদ্রা তৈরি করার ঘটনা কমে যেতে লাগলো কারণ যখন ধাতু দিয়ে মুদ্রা তৈরি করা শুরু হলো তখন ধাতুর নিজের দামই বেশি ছিল। যদি পুরনো মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতুর দাম ফেইস ভ্যালুর চেয়ে বেশি থাকতো তাহলে লোকজন ওই মুদ্রা গলিয়ে ধাতু বিক্রি করে দিত। একইভাবে যদি নিম্নমানের কোনো পণ্য উচ্চমানের পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় তাহলে বাজারে ওই উচ্চমানের পণ্যের দাম কমে যায় কারণ ক্রেতারা উচ্চমানসম্পন্ন পণ্যের প্রকৃত মূল্য (real value) বুঝতে পারে না। অর্থাৎ ক্রেতারা সস্তা ও দামি পণ্য একই মানে নামিয়ে ফেলে।
আরো পরে স্বর্ণ কিংবা রূপার মুদ্রার এই দরপতনের সমস্যা সমাধানের জন্য তামা, নিকেল এবং টিনের মতো ধাতুর ব্যবহার শুরু হলো। কাগজের মুদ্রা প্রচলনের ফলে স্বর্ণ মুদ্রার ব্যবহার দিন দিন কমে গেল। কাগজের মুদ্রা বহনের ক্ষেত্রে সুবিধা বয়ে এনেছিল কারণ কাগজ তুলনামূলক অনেক হাল্কা ফলে একসঙ্গে বহুদূরে অনেক বেশি মুদ্রা বহন করা সম্ভব হলো। এভাবেই কাগজের মুদ্রা আধুনিক বিশ্বে লেনদেনের বাহন হয়ে গেল এবং স্বর্ণ ও রুপার মুদ্রা হারিয়ে গেল।
এতো গেলো স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার হারিয়ে যাওয়ার ইতিকথা। শেষ করে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একটি গল্প দিয়েঃ
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত নাবিক। বিকল্প একটি বাণিজ্য রুট প্রতিষ্ঠার জন্য স্পেনের রাণী ইসাবেলা তাকে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পাঠালেন। এজন্য রাণী তাকে অর্থও যোগান দিলেন। আশা ছিল অভিযান থেকে তিনি সোনা-রূপাসহ প্রচুর সম্পদ নিয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি পথ ভুলে চলে গেলেন আমেরিকার ইন্ডিয়ানায়।
প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে, কলম্বাসই প্রথম কোনো ইউরোপীয় নাবিক যিনি আমেরিকায় সমুদ্র অভিযান চালিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বাস ঠিক নয়। কলম্বাসের আগেই একাদশ শতাব্দিতে নরওয়ের নাবিক লিফ এরিকসন প্রথম আমেরিকায় অভিযান চালান। ইউরোপীয়রা যখন দিকে দিকে অভিযান চালাচ্ছে, বিজয়ী হচ্ছে এবং উপনিবেশ স্থাপন করছে তখন নরয়ের এ নাবিক আমেরিকায় অভিযান চালান। ইউরোপীয়দের সেই উপনিবেশ ও বিজয় কয়েক শতাব্দি স্থায়ী হয়েছিল।
যাহোক, ১৪৯২ সালে বিখ্যাত সেই অভিযাত্রায় কলম্বাস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- যে ব্যক্তি প্রথম মাটি দেখবেন তাকে তিনি স্বর্ণ দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর রোদ্রিগো ডি ত্রিয়ানা নামে এক নাবিক প্রথম মাটি দেখতে পেলেন। তিনি প্রথম একটি ছোট্ট দ্বীপ দেখলেন যার বর্তমান নাম বাহামা দ্বীপপুঞ্জ। কলম্বাস সেই দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন স্যান স্যালভাদর। কিন্তু মি. ডি ত্রিয়ানাকে কখনো সেই পুরস্কার দেয়া হয় নি বরং সেই পুরস্কারটি কলম্বাস নিজের কাছে রেখে দিলেন। তিনি সবাইকে বললেন, আগের রাতে তিনি একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন। সে আলোর কথা তিনি কাউকে বলেন নি এজন্য যে, তা ছিল খুব ক্ষীণ বা অল্প আলো। এই অবিচারের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য সেভিলের একটি পার্কে তার একটি সুন্দর মূর্তি রয়েছে যেটা মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মন্তব্য করুন